ব্রেকিং নিউজ

বারাকপুর মহকুমা : তৃণমূল-বিজেপি'র টানাপোড়েন নিয়ে হস্তক্ষেপ করলেন রাজ্যপাল

সাতদিনের সমাচার : মহকুমা জুড়ে ক্রমশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠছে তৃণমূল বিজেপির রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব । ভাটপাড়া, জগদ্দল জুড়ে  রাজনৈতিক হিংসা এখন যেভাবে  সন্ত্রাসের চেহারা নিয়েছে, তাতে রীতিমত শঙ্কিত এ রাজ্যের  নবাগত রাজ্যপাল জগ্দীপ ধনকর l এ নিয়ে গতকাল পুলিশ কমিশনার জ্ঞানবন্ত সিংকে জরুরি তলব করেছিলেন তিনি। প্রশ্ন দুটি ; কেন এই মহকুমাতে সন্ত্রাস কমানো যাচ্ছে না এবং কেনইবা বারবার পুলিশের বিরুদ্ধে আঙুল উঠছে? 
মাস তিনেক ধরে এই মহকুমার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
তাঁদের ব্যাখ্যা, প্রথমত তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি হওয়া মুকুল রায়ের হাত ধরে তাঁর একসময়ের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী বিধায়ক অর্জুন সিং দলবদল করেন, এর পরপরই লোকসভা নির্বাচনে অর্জুন জিতে যাওয়ায় বারাকপুর কেন্দ্র হাতছাড়া হয়েছিল তৃণমূলের । একই সময়ে নিজের ছেড়ে যাওয়া আসনটিকেও অর্জুন রক্ষা করেছিলেন নিজপুত্র পবনকে জিতিয়ে। সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে মহকুমার পুরসভাগুলির তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিরা  মুকুল-অর্জুনের ডাকে সাড়া দিচ্ছিলেন। ফলে পুরসভাগুলিও একে একে হাতছাড়া হচ্ছিল তৃণমূলের। অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে মরিয়া হয়ে তৃণমূল বিভিন্ন পন্থা নিতে শুরু করে, অভিযোগ সুবোধ অধিকারীর মতো স্বঘোষিত সমাজসেবীকে জেলানেতা বানিয়ে কুখ্যাত সমাজবিরোধীদের জেল থেকে ছাড়ানো হয়েছে বিশেষ শর্তে যাতে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যায় , অর্থাৎ বিজেপি তথা অর্জুন সিংহের সঙ্গে এঁটে উঠতে গেলে বোমাবাজিতে সিদ্ধহস্তদের ময়দানে নামাতে হবে, সুতরাং  নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে  বিশেষত ভাটপাড়া থেকে জগদ্দল  এখন দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্য। দিনের পর দিন এলাকার মানুষ হয় ঘরছাড়া হয়েছেন, নয় ঘর থেকে বেরোতে পারছিলেন না। পুলিশের সাথে কমব্যাট ফোর্স হিমশিম খাচ্ছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। এরমধ্যেই দলবদল করেন তৃণমূলের দুই বিধায়কও। মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশু ও অর্জুনের ভগ্নিপতি সুনীল সিং। ততদিনে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দিকে আঙুল উঠতে শুরু করেছে। তৃণমূল সহ স্থানীয়দের একাংশ আবার আঙুল তোলেন অর্জুনের দিকেও। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে মুখ্যমন্ত্রী ভাটপাড়া অঞ্চলে নতুন একটি পুলিশ ফাঁড়ি করেন। ধীরে ধীরে ঐ অঞ্চল শান্ত হাতে শুরু করে। যদিও বিজেপি'র ক্লাবঘর ও দলীয় কার্যালয় দখলদারিকে আঘাত করতে এরপর পরিকল্পনা বদলান মমতা। তৃণমূলের দলীয় কর্মীদের সাথে পুলিশ যোগ দেয় ক্লাব পুনরুদ্ধারে। হালচাল দেখে মাসখানেকের মধ্যে ঘরে ফিরতে শুরু করেন পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলররা। বিজেপি'র হাত থেকে  নিজেদের কার্যালয় পুনরুদ্ধার করাও শুরু হয়ে যায় মহকুমার সর্বত্র। এরকম দখলদারিকে কেন্দ্র করেই দিন তিনেক আগে শ্যামনগরে ঘটে গেছে রক্তারক্তি কান্ড। মহকুমার সাংসদ অর্জুন ঘটনাস্থলে গিয়ে মাথায় বড়সড় আঘাত পান। বেপরোয়া লাঠিচার্জে আহত হন কয়েকজন বিজেপি কর্মীও। স্বভাবতই ব্যাপারটি অন্য রূপ নেয়। ঘটনার জন্য অর্জুন প্রথমে খোদ মহকুমার ভারপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা মনোজ ভার্মাকে দায়ী করে বলেন, 'ভার্মাই আমার মাথায়  মেরেছে।' তাঁকে আর তাঁর পুত্রকে খুনের চেষ্টা হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে সেদিনের ঘটনায় মারমুখী বিজেপি কর্মীরা অবরোধ তুলে পুলিশের ওপর ইঁট ছুঁড়তে শুরু করে। তাদের হটাতে পুলিশও মারমুখী হয়ে ওঠে। সাংবাদিকদের আঘাত করেন পুলিশকর্তা অজয় ঠাকুর। খোদ মনোজ ভার্মাকে দেখা যায় শূন্যে গুলি ছুঁড়তে। তখনকার মত পুলিশ পরিস্থিতি সামলাতে পারলেও পরবর্তী পরিস্থিতিতে পুরো মহকুমা তো  বটেই অর্জুনের আহত হওয়ার খবরে রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ শুরু করেন বিজেপি কর্মীরা।
কলকাতার নার্সিংহোমে অর্জুনকে অন্যান্যদের মধ্যে দেখতে যান মুকুল রায়ও। তাঁর বলা 'মমতার নির্দেশে অর্জুনকে খুনের চেষ্টা হয়েছিল' মন্তব্য ভস্মে ঘি ঢালার মত কাজ করে। রাজ্যে পরদিন ১২ ঘন্টার ডাক দেয় বিজেপি। সেদিনও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। অর্জুনকে দেখতে যান খোদ রাজ্যপালও। 
ইতিমধ্যে অর্জুনের মন্তব্যের বিরোধিতা করে তৃণমূলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলে বসেন, অর্জুন নাকি নিজের মাথা নিজেই ফাটিয়েছেন। যা হাস্যস্কর বলে উড়িয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে খুনের ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ দায়ের হয়। পাল্টা মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মামলা ব্যারাকপুর মহকুমায় এসে করেন রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও।
ঘটনার খোঁজখবর নিতে খোদ পুলিশ কমিশনার জ্ঞানবন্ত সিংকে রাজভবনে ডেকে পাঠান রাজ্যপাল। গতকাল খোদ সাংসদ অর্জুন সিং নার্সিংহোম থেকে ভাটপাড়ার বাড়িতে ফিরে সাংবাদিকদের বলেন,  মমতা ব্যানার্জি তাঁকে ও তাঁর ছেলে পবনকে খুন করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। তাঁর বাড়ি থেকে বোমা ছোঁড়া হয়েছে বলে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাতে চাইছেন। এদিন তিনি পূর্বের দাবি থেকে সরে এসে সাংবাদিকদের বলেন, প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, মনোজ ভার্মা তাঁকে লাঠি দিয়ে মেরেছেন, কিন্তু পরে নার্সিং হোমে গিয়ে নাকি বুঝতে পারেন, লাঠি নয় মনোজ বর্মা সম্ভবত তাঁকে রিভলবারের বাঁট দিয়ে মেরেছেন। কারণ তাঁর মাথার ক্ষত গভীর ছিল।
স্বভাবতই ঘটনার জন্য কে, কতটা দায়ী তা নিয়ে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে রাজ্য জুড়ে। রাজ্যের মানুষের চোখ-কান এখন অশান্ত ব্যারাকপুর মহকুমার দিকেই l

No comments